-কাজী মোঃ হাসান
এই স্কুলে আসার পর মোহাম্মদ আলী, সিরাজ, ইব্রাহীম, বলাই, অনিমেষ, জিতা, নারায়ণ, নুর ইসলাম, ভুন্ডুল, শান্তি, ওয়াজদ্দিন, হরিপদ- এরা সবাই রঞ্জুর এক নম্বর বন্ধু। সেদিন সবার সঙ্গে ওরাও ছিলো স্যারের কৃতিত্ব দেখতে।
প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর সবাই এক সাথে হাটতে হাটতে বাসায় ফেরে। লম্বা পথ। স্কুল আর বাড়ির মাঝখানে দু’টি গ্রাম, তিনটা চক (ক্ষেত)। চকগুলো বেশ বড়।
স্কুলে যাওয়ার পথে প্রথম চকের পরেই কৃষ্ণপুরা। গ্রামটা খুব বড় না হলেও ভেতরের রাস্তাটুকু বেশ প্রশস্ত। যেন খেলার মাঠ। ফুটবল, কবাডি, দাইরচা- সব কিছুই খেলা যায় এখানে। তার উপর রাস্তার সবটা জুড়েই গাছের ছায়া। মোটকথা খেলাধুলার জন্য একদম ফাটাফাটি জায়গা।
বাড়ি ফেরার পথে প্রতিদিন এখানে এসেই ছাত্রদের দলটা থামে। কেউ আগে এলেও ক্ষতি নেই। অপেক্ষা করে পেছনে থাকা বন্ধুদের জন্য। কারণ একটাই- বাড়ির ফেরার আগে কিছুটা খেলাধুলা করা।
একদিন কবাডি খেলছিলো রঞ্জুরা। খেলার এক পর্যায়ে মোটকু শান্তি ডু দিতেই হঠাৎ উড়ো কেস দেয় ভুন্ডুল। অথচ খেলার শুরুতেই কথা ছিলো, কেউ কাউকে উড়ো কেস দিতে পারবে না। কারণ, এতে দু’জনের বিপদ! যে ডু দিতে আসে তার গলা লক্ষ্য করেই কেসটা দেয়া হয়। গলায় কেস পড়লে শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। আর কেস লাগাতে না পারলে, যে দেয়, সে পড়ে গিয়ে মারাত্মক ব্যথা পায়। সুতরাং দু’দিক থেকেই বিপদ। তাই উড়ো কেস একদম বন্ধ। তার পরও নিয়ম ভেঙ্গে উড়ো কেস দেয় ভুন্ডুল।
উড়া কেস খেয়ে শান্তির শ্বাস প্রায় বন্ধ। গলায় খকখক কাশি উঠে। ব্যাথায় টনটন করে। রাগে গরম হয়ে যায় শান্তির মাথা। তাই সে যাত্রায় ছাড়া পেয়ে প্রচন্ড আক্রোশে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়ে ভুন্ডুলের উপর –
: এই ভুন্ডুইল্যা, উড়া কেম দিলি কেন? তুই আমারে চিনছ? এক থাপ্পরে তরে মাটির একশ’ হাত ভিতরে পুইত্যা রাখমু।
রাগে কটমট করতে করতে জাপটে ধরে ভুন্ডুলকে। প্রথমে কিল-ঘুষি, তারপর চুল ধরে টানাটানি। এ নিয়ে তুমুল হট্টগোল। রঞ্জুরা উভয়কে ছাড়াবার চেষ্টা করে। দু’জনকে ঠেলতে ঠেলতে দু’দিকে নিয়ে যায়। তাতেও কাজ হলে না। ধাক্কাধাক্কি করে আবার দু’জনেই ফিরে এলো বীর বিক্রমে। কয়েক দফা কিলাকিলির পরও রাগ মিটে না কারোর।
এবার মল্ল¬যুদ্ধ। প্রতিপক্ষকে হারাবার আগ পর্যন্ত কেউ কাউকে ছাড়তে নারাজ। হঠাৎ শান্তিকে ল্যাং মেরে মাটিতে ফেলে দেয় ভুন্ডুল। তার পর চেপে বসে বুকের উপর। কিন্তু একটু পড়েই তাকে নীচে ফেলে উপরে উঠে আসে শান্তি। চলে গড়াগড়ি। একবার ভুন্ডুল নীচে পড়ে তো আবার শান্তি।
একবার ভুন্ডুলকে নীচে ফেলেই চিৎকার করে মাঠ কাঁপিয়ে তোলে শান্তি-
: এই ভুন্ডুইল্যা, এবার উড়া কেস দেয়ার মজাটা বুইজ্যা দেখ!
অন্য দিকে ভুন্ডুল নীচ থেকেই হুঙ্কার ছাড়ে-
: চুপ থাক মোটকু! চিপটা কেমন লাগছে- সেই খবরটাই আগে ক! আর একটু টাইট দিলেই তো নিজের নামটাও ভুইল্যা যাবি! তখন মজাটা বুঝবি!
এভাবে দু’জনের মধ্যে বাক্যবান, কিলাকিলি, দস্তাদস্তি ও মল্লযুদ্ধের সব আইটেম শেষ। যেন রাম-রাবণের যুদ্ধ। রঞ্জুরা ঝগড়া থামাতে ব্যর্থ হয়ে ব্যাপারটা আপনা-আপনি শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। সময় যায়। মল্লযুদ্ধ দেখতে দেখতে রঞ্জুরা কখনো হাত তালি দিয়ে, কখনো বা চুটকি কথায় পরিবেশটা হালকা করার চেষ্টা করে।
এক সময় গড়াতে গড়াতে ওরা দু’জনেই রাস্তার খাদে গিয়ে পড়ে। খাদে পড়ে দু’ জনেই চিৎ পটাং। দু’জনের অবস্থাই কাহিল- বলতে গেলে বেহুশ। খাদ থেকে উঠার শক্তিটুকুও নেই। হাতে-পায়ে প্রচ- ব্যথা। এ ছাড়া একজনের ঠোঁট বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, আর অন্যজনের কপাল ফুলে ঢোল। শেষমেশ চেংদোলা করে গর্ত থেকে তুলে আনা হয় তাদের।
ঝগড়া-ঝাটি যতই হোক, মিল হতেও বেশী সময় লাগে না। একটু পরেই হাত-পা মুছে, জামা কাপড় পড়ে, মিলে-মিশে বাড়ির পথে রওনা হয় তারা।
(চলবে———–)
‘রঞ্জুর ছেলেবেলা’ থেকে
২১/০৮/২০২৩
মিরপুর, ঢাকা।